স্বদেশ ডেস্ক:
দুই সপ্তাহেরও কিছু বেশি আগে হংকংয়ে গণতন্ত্রপন্থিদের বিক্ষোভে সেøাগান ছিল ‘চীনের কাছে প্রত্যর্পণ বিল নয়’, ‘এই বিল প্রত্যাহার কর’। লাখ লাখ হংকংবাসী এসব সেøাগানে মুখর ছিল। বিক্ষোভ ছিল অনেকটা শান্তিপূর্ণ। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে বিক্ষোভে পরিবর্তন আসছে।
বিশেষ কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সেøাগানের পরিবর্তনও হয়েছে। নতুন যে সেøাগান তাতে হংকংয়ের স্বাধীনতার দাবি বেশ স্পষ্ট। সরাসরি স্বাধীনতার কথা না বললেও বলা হচ্ছে, ‘এটাই বিপ্লবের সময়’, ‘হংকং মুক্ত কর’। আর বিক্ষোভের সঙ্গে যোগ হয়েছে সংঘর্ষ-সহিংসতা। নিরাপত্তা বাহিনী যেমন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে তেমনি আন্দোলনকারীরা বেপরোয়া আচরণ করছে।
হংকংয়ে চলমান বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল মূলত আসামি প্রত্যর্পণ বিলকে কেন্দ্র করে। ওই বিলে বলা ছিল, বিচারের জন্য আসামিকে চীনের মূল ভূখ-ে পাঠাতে হবে। এর বিরুদ্ধে পথে নামে হংকংয়ের সর্বস্তরের জনগণ। প্রথম দিকে প্রায় আশি লাখ মানুষ এতে অংশ নিয়েছিল। চীনের কাছে হংকংকে হস্তান্তরের পর এত বড় বিক্ষোভ আর হয়নি।
তোপের মুখে হংকংয়ের প্রশাসন আসামি প্রত্যর্পণ বিলটি স্থগিত করে। এর পরও বিক্ষোভকারীরা দমে যায়নি। হংকংয়ের প্রধান নির্বাহী ক্যারি লাম পর পর দুইবার ক্ষমা চান এবং বিলটিকে ‘মৃত’ বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু এবারও আন্দোলনকারীরা শাসকদের কথায় আস্থা রাখতে পারেনি। এর পর শুরু হয়, ক্যারি লামের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ। মূলত এর পর থেকে আন্দোলনের ‘চরিত্রে’ পরিবর্তন আসে।
বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা কমেছে কিন্তু তাদের আচরণ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিক্ষোভের অনুমোদন না থাকলে অথবা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সরকারি ভবন ও মূল রাস্তা দখল করে বিক্ষোভ চলতে দেখা যায়।
এবার আসা যাক এ আন্দোলনের নেপথ্যে কে কাজ করছেন? হংকংয়ে আন্দোলনের মূলে রয়েছেন একজন নেতা, যার নাম এডওয়ার্ড লিওং টিন-কিই। তিনি সর্বপ্রথম জনসম্মুখে আসেন ২০১৪ সালে ‘ছাতা আন্দোলনের’ মধ্য দিয়ে। সেই আন্দোলনও বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। এর পর ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লিওং হংকংয়ের কাউন্সিলের উপ-নির্বাচনে প্রার্থী হন।
মাত্র ১৫ ভোটের ব্যবধানে হেরে গিয়ে বেশ ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। সেই সময় তিনি হংকংয়ের স্বাধীনতার দাবি তোলেন যা হংকংয়ের মূল আদর্শ ‘এক দেশ দুই নীতির’ সম্পূর্ণ বিপরীত। এর প্রেক্ষিতে গত বছর তার ছয় বছরের জেল হয়। এখানেও লিওংয়ের নামের গল্প শেষ হয়ে যায় না। ধারণা করা হচ্ছে, সম্প্রতি বিক্ষোভের যে বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন এসেছে সেখানেও তার প্রেরণাই কাজ করছে।
সম্প্রতি বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারীকে আটক করেছে পুলিশ। গত বুধবার ৪০ জনকে আদালতে তোলা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে দাঙ্গার অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের ১০ বছরের জেল হতে পারে। এ দিকে পরিস্থিতি সামাল দিতে হংকংয়ের চীনা সেনারা হস্তক্ষেপ করতে পারে। বৃহস্পতিবার চীনা সেনারা তিন মিনিটের একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে যাতে দেখা যায়Ñ সেনারা দাঙ্গা মোকাবিলায় মহড়া দিচ্ছে। এতে ধারণা করা হচ্ছে বিক্ষোভকারীরা আর কিছুদিন রাস্তায় অবস্থান করলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
হংকংয়ের বিক্ষোভে সমর্থন রয়েছে যুক্তরাজ্যের। এর ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। কেননা এক সময় হংকং ছিল যুক্তরাজ্যের উপনিবেশ। প্রায় ১৫০ বছর যুক্তরাজ্যের অধীনে ছিল এই দ্বীপ অঞ্চলটি। এর পর আশির দশকে যুক্তরাজ্য এটিকে চীনের কাছে হস্তান্তর করে। কিন্তু সেই সময় শর্ত জুড়ে দেওয়া হয় যে হংকংয়ের নাগরিকরা মত প্রকাশের স্বাধীনতা পাবে এবং স্বায়ত্তশাসন কার্যকর থাকবে। মূলত এই নীতির কারণে বলা হয়েছে ‘এক দেশ, দুই নীতি’। অর্থাৎ হংকং চীনের অন্তর্ভুক্ত হলেও চীনের মূলভূখ-ে যে কঠোর নীতি রয়েছে তা হংকংয়ে চলে না। কিন্তু প্রশাসনিক নানা কর্মকা- বেইজিং প্রভাব বিস্তার করে থাকে। এমনকি হংকংয়ের যে আইনসভা রয়েছে সেখানেও চীনাপন্থিদের প্রভাব বেশি। এ কারণে আইনসভা ধারণা করেছিল যে তারা সহজেই আসামি প্রত্যর্পণ বিল পাস করতে পারবে। কিন্তু এখন দেখা গেল এ বিল পাস করতে গিয়ে গোটা পরিস্থিতি জটিল রূপ নিচ্ছে। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, সামনের দিনে হংকংয়ের স্বাধীনতার দাবি আরও জোরালো হবে। তারা চাইবে চীনের যে কোনো প্রভাবমুক্ত হয়ে নিজেদের মতো সব নিয়ন্ত্রণ করতে। আর এতে যুক্তরাজ্য তো বটেই, রসদ জোগাবে যুক্তরাষ্ট্রও। কেননা চীনের যে কোনো স্বার্থে আঘাত করতে পারাকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের কূটনীতিক বিজয় মনে করে।